Jan 2, 2014

পূর্ণিমাতে পটিয়ায় ক্যাম্পিং।



জুমন ভাইর সাথে চ্যাট হচ্ছিল ফেসবুকে। হটাত সে একটা প্রস্তাব দিল চলেন সজল ভাই কোথাও একটা ক্যাম্পিং করি। আপনে আর আমি তো বেশ কদিন হলো আপনার লাল তাবুতে থাকিনাআমিও মত দিলাম। চলেন কোথাও যাই ... দু-চাইরডা মুরগী পোড়াই খেয়ে আসি আর তাবুর ভেতর থেকে চাঁদ দেখি। আমি , মামুন ভাই আর জুমন ভাই এই থ্রি ম্যাসকেটিয়ারের কোন ট্রিপ প্লান হলে সাধারণত প্লানার বা ম্যানাজার ক্যাম কুক আমিই থাকি। এ দুজন আমার উপর সকল দায়িত্ব দিয়ে নাক ডেকে ডেকে ট্রিপে ঘুমায় আর ফটো খিচে। কিন্তু এবার তা হতে দিলামনা। সব দায়িত্ব ছেড়ে দিয়া হলো জুমন ভাইর উপর। তো উনি প্লান করলেন আমারা মামুন ভাইর বাসায় ক্যাম্প করবো। উনার পটিয়াতে বাড়ী আছে। মামুন ভাইকে বলতেই উনিও এক পায়ে খাড়া ।


একদিন জুমন ভাই টুং করে ফেসবুকে একটা মেসেজ দিল ২৮ তারিখ (২০১২) রোজ শুক্রবার জুমার নামাজ পড়েই যেন উনার বাসায় চলে আসি। মেসেজটা এদ্দুর পড়েই খুশি হয়ে গেলাম যে নিশ্চয় লান্চটা উনার বাসায় খাওয়া যাবে। দেখি মেসেজের শেষ অংশে লেখা ভাত-টাত খেয়ে আসবেন। তো আরকি ২৮ তারিখ বিকাল তিনটার ভেতরে উনার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে ৩:৩০ এর মধ্যে ফয়েজ লেকের গেটে বাস থেকে নেমে গেলাম। উনি ফোন করে বলল যে আর কষ্ট করে আসতে হবেনা। ফয়েজ লেকের গেইটে অপেক্ষা করতাম। উনারা আসতাছেন। সে অপেক্ষা প্রায় ৩৫ মিনিট। অর্থাৎ আমি ৩৫ টা মিনিট ফয়েজ লেকের মুল গেইটের পাশের ফুতপাতে বসে বসে আঙ্গুল চুসলাম আর সুন্দর সুন্দর তরুন তরুনীদের দেখতে লাগলাম। অবশেষে বিশাল লটবহর নিয়ে জুমন ভাই হাজির। ব্যাগের পেছনে ইয়া বড় একটা স্লিপিং ব্যাগ (তবলীগের স্লিপিং ব্যাগ)  বাধা। হাতে দুটা বড় বড় তাবু প্যাক করা। উনাকে দেখতে মনে হচ্ছিল বাড়ি থেকে বের করে দিছে। সাথে আবার কাশ্মিরের কিছু ছেলে আছে।এরাও আজকে রাতে ক্যাম্পিং করবে আমাদের সাথে। বেচারারা দেখি এ ঠান্ডার মধ্যেও হাপ প্যান্ট পরে ঘুরতেছে। যেন বলতে চাচ্ছে আরে বাংলাদেশের ঠান্ডাতো আমাদের কাশ্মীরের ঠান্ডার কাছে কিছুইনা।

তো আমরা দুটা সিএনজি নিয়ে সোজা চলে গেলাম নিউ মার্কেট এর বাটার দোকানের সামনে । সেখানে আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম বাকিদের জন্য। একটু পরেই আমাদের লেট লতিফ মামুন ভাই তার দুই দোস্ত নিয়ে হাজির। তো আমরা এখন টোটাল কতজন হলাম ? ও হা টোটাল ৯ জন। ৩টা রিক্সা নিয়ে আমরা এবার ফিরিঙ্গী বাজার হয়ে চলে এলাম নতুন ব্রিজ মোড়। ম্যানাজার সাহেব দৌড়াতে দৌড়াতে গেলেন আমাদের গাড়ীর ব্যাবস্থা করতে। সে ইয়া ছোট একটা টাটা ব্রান্ডের বিচিত্র একটা গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে এলো। আমার গদাগদি করে বসলাম সেটায়। মাত্র নতুন ব্রিজে উঠলো গাড়ি আর কড়া ব্রেক মারতে হলো ড্রাইভারকে। আমাদের আত্মভোলা মেনাজার সাকিব নামে পিচ্চি একটা ছেলেকে পেছনে ফেলেই তার যাত্র শুরু করে দিয়েছিল। তো আমরা গাড়ি একদিকে পার্ক করে গল্প আর ফটো খিচতে লাগলাম। একটু পরেই এ টিমের সবচেয়ে ছোট মেমবার সাকিবের হাজির খোড়াতে খোড়াতে। মেনাজার সাহেব তাকে আচ্ছা তরে বকলো। তারপর আমার একটা গ্রুপ ফটো তুলে আমাদের দীর্ঘ মাত্র ৩০-৩৫ মিনিটের যাত্রার জন্য গাড়িতে উঠলাম।

ছবি:- পুরা টিম। (ফটো ক্রেডিট ডিরাইভার সাহেব)
   
আমি আর জুমন ভাই মামুন ভাইর বাসায় ডুকার আগে পটিয়া ক্যান্টনমেন্ট বাজারে নেমে গেলাম। বাকিরা ক্যাম্পসাইট বা মামুন ভাইর বাসায় চলে গেল। আমরা বাজার করতে লাগলাম। মুরগী পাইতো ড্রেসিংএর লোক পাইনা। ড্রেসিংএর লোক পাইতো মুরগি পাইনা। আমি আর জুমন এক দোকান থেকে আরেক দোকানে গিয়ে মুরগী বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে লাগলাম। ওই লাইনের প্রায় সব দোকানে টু মারলাম। আমি নিশ্চিত মানুষ জন আমাদের পাগল ভাবতে লাগছিল তখন। মুরগী নিয়ে ক্যাচাল করে এ ভাবে নইলে কেউ ? আমার কাছে এর থিক্কা বান্দরবানে পাড়ার থেকে মুরগী কিনা সহজ মনে হইছিল। শেষে এক দোকান থেকে মুরগী কিনলাম। সেই দোকানি এক লোক ঠিক করে দিল যে কেটে কুটে পরিস্কার করে দিবে মুরগী। এ ফাকে আমরা পরটা,তৈল,নুন কিনে ফেল্লাম। সব বাজার করে আমরা অন্ধকারে হাতড়ে-হুতড়ে  মামুন ভাইর বাড়িতে গেলাম। যায় দেখি মুমন ভাই এক পাশলা ঘুম দিচ্ছে। তার দোস্তরা গল্প করতেছে। সাকিব কাশ্মীরের ওই ৪ জনের সাথে বসে বসে ইন্ডিয়া পাকিস্তানের খেলা দেখতেছে। আমরা রেস্ট নিয়ে প্রথমে ইট ম্যানেজ করলাম। ক্যাম্প করার জন্য জায়গা পরিস্কার করলাম। কয়লা সেট করলাম। সকল কাজে আমাকে মামুন ভাইর ঘর দেখাশুনা করার জন্য দু জন লোক আছে তারা সাহায্য করলো। আর যার বাড়িতে এত আয়োজন সে কম্বল মাথায় দিয়ে ঘুম। এজন্য ই বলে যার বিবাহ তার খবর নাই , পাড়া পড়শির ঘুম নাই। তো আমি যখন মুরগী বারবিকিউ আর খাওয়া দাওয়ার আয়োজন নিয়ে ব্যাস্ত তখন জুমন ভাই দেখি তার সদ্য কেনা হেমক গাছে ঝুলিয়ে ঘুম।
ছবি:- জুমন ভাই তার হেমকে।

আমি মুরগী মেরিনেট করতে দিলাম। সাকিব আমাকে যথেষ্ঠ সাহায্য করলো। এরপর আমারা তাবু গুলা খাটিয়ে মামুন ভাইর পুকুর পাড়ে গল্প করতে বসলাম চাঁদের আলোর নিচে। অনেক গল্প হলো , মামুন ভাইর বন্ধুর গলায় গান শুনা হলো , লোকটা ভালই গান গাইতে পারে। মাথার উপর চাদের আলো। সামনে টলটলে পুকুর আর সাথে এমন গান। আমি কিছু বলার আগেই কাশমীরের ওই ছেলেদের একজন বলে উঠলো “Strange so strange” তাদের অনুভুতিটা বুঝার চেস্টা করলাম। তারা তাদের দেশ থেকে এত দুরে এরকম কোন কিছু দেখবে হয়তো ভাবেনি। সেদিন চাঁদটা সত্যিই অসাধারণ ছিল।
ছবি:- পুকুর পাড়ে গল্প আর গান।



ছবি:- বাশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই।

হটাৎ জুমন ভাই বলল চলেন চাদের আলোয় নৈকা চালাই। যেই বলা সেই কাজ। আমরা চলে গেলাম বোট নিয়ে পুকুরের একেবারে মাঝখানে। আমরা শুধূ বাঙ্গালিরা। কাশমীরের ওরা সাতার জানেনা একজনেও,তাই পাড়ে দাড়িয়ে দাড়িয়ে আফসোস করতেছিল। পুকুরের মাঝখানে সেই আবার গানের আসর। তাও বোটে বসে বসে। সেই রকম অনুভুতি। বাইদিওয়ে আমাদের বোটের ড্রাইভার ছিল জুমন ভাই।
ছবি:- রাতের বেলায় চাদের আলোর নিচে বোটে গান শুনা।

একসময় বারবিকিউর সময় চলে এলো। আমি জুমন আর সাকিব বারবিকিউ কিউ করতে লাগলাম। বাকিরা বসে বসে মুখের লোল ফেলতে লাগলো। আমি আমার সিক্রেট মসলা ব্যাবহার করছিলাম। গন্ধে শুধু মামুন ভাই ঘুম থেকে উঠে আসলো।

ছবি:- তাবুর পাশে আমি আর জুমন ভাই বারবিকিউতে ব্যাস্ত।
 
বারবিকিউ খেলাম আমরা। এরি ফাকে মামুন ভাই তার লোকদের বলে নুডুলর্স এর ব্যাবস্থা করে ফেল্ল। সো আমাদের সে রাতের টোটাল ফুড লিস্ট হলো :- চিকেন বারবিকিউ সাথে পরটা আর বাকরখানি ,সালাদ , নডুলর্স আর কফি। ডেজার্ট হিসেবে খেলাম ফালুদা আইসক্রিম দিয়ে। খাবারটা ভালই জমছিল। মজা করে খেলাম। জুমন মিয়া তো কাড়াকাড়ি শুরু করে দিছিল।

সে দিন তাপমাত্রা মনে হয় ৮ থেকে ৯ ডিগ্রি ছিল। সাথে ঠান্ডা বাতাস। তাই ঠান্ডার কামড ভালই পাচ্ছিলাম। বারবিকিউ করার কয়লার আগুনও বস মানতেছিলনা। তাই ক্যাম্পফায়ারের আয়োজন করা হলো। সবাই গল্প আর তাপ পোহাতে লাগলাম। মাঝে আমি একাবার উঠে গিয়ে কফি করে আনলাম সবার জন্য।
ছবি:- ক্যাম্প ফায়ারের আগুনে।


ছবি:- পেছনে চাঁদ আর সামনে আমরা আগুনে বসে গরম পোহায়।
খাওয়া দাওয়া সব শেষে আমরা গল্প করতে ভেতরে গেলাম। সেদিন গল্পের তুফান বয়ে গেল।  কত গল্প , কত মজার মজার গল্প। হাসতে হাসতে খাওয়া হজম হয়ে গেছিল। এ আড্ডা শেষ হলো রাতের দুটায়। সবাই তাবুতে ঘুমাতে গেলাম। মামুন ভাই আর তার বন্ধুরা বাসার ভেতরেই ঘুমালো। আমরা তাবুতে। প্রচন্ড ঠান্ডার একটা রাত কাটালাম আমরা।

ছবি:- জুমন তার স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে।
 
সকালে প্রচন্ড ঠান্ডায় কাপতে কাপতে তাবু থেকে বের হলাম। রাতে ভাল ঘুম হয়নি।প্রচন্ড ঠান্ডা ছিল।

ছবি:- আমাদের ক্যাম্প সাইট।
ছবি:- আমি দাড়িয়ে দাড়িয়ে চিন্তা করতেছি রাতে কিনা ঠান্ডা ছিল।
গতকাল রাতের আধারে মামুন ভাইর বাড়ী ভাল করে ঘুরে দেখতে পারিনি। এখন সকালের আলোয় দেখতে লাগলাম। বাড়ী বললে ভুল হবে মুটামুটি প্রসাদ আছে একটা। বাড়ীর দুইপাশে খোলা উঠোন যা কিনা গাছপালা দিয়ে ঢাকা। আর সামনে পেছনে বিশাল বিশাল দুইটা পুকুর আর পুকুরে বোট আছে। দাড় টানা বোট। খুবই সুন্দর গ্রাম্য একটা পরিবেশ। আমার পুরা গ্রামটা ঘুরে দেখলাম। খুবই সুন্দর একটা গ্রাম। কাশ্মীরের পোলাপাইনরা এলাকার পিচ্চি দের সাথে ক্রিকেট খেলায় মেতে উঠলো আর একজন মামুন ভাইর সাইকেল চালিয়ে পুরা হাওয়া। কোন এক ফাকে জুমন ভাই আমার বেকপ্যাক থেকে বিস্কুট নিয়ে হাপিস করে ফেল্ল। কারো জন্যই রাখলোনা।

ছবি:- বিস্কুট চোর।
ছবি:- সাইকেলে গ্রাম একসপ্লোর চলছে।
ছবি:- গ্রামের একটা বাড়ী।
ছবি:- মুরগীর বাচ্চা।
  এরপর আমরা আবার মামুন ভাইর বাসায় ফেরত আসলাম। সিঙ্গাড়া দিয়ে চা খেলাম। কাশ্মীরের দুজন বোট নিয়ে পুকুরে নেমে গেল। দিনের বেলা তাদের ভয় কেটে গেল মনে হয়। জুমন ভাই তাদের প্রশ্ন করতেই বলল তারা গুলির শব্দে বড় হয়েছে আর এ তো সামান্য পুকুরের পানি। এভাবে অনেক মজা করলাম আমরা।

ছবি:- পুকুরে সাহসী কাশমীরি যুবক।

 ছবি:- পুকুরে সাহসী যুবকদের বোট চালানো।


ছবি:- আমাদের শিল্পি যিনি রাতে গান গেয়েছিল।
ছবি:- আমাদের পুরা টিম।
এরপর আর কি আমরা ১১টা পর্যন্ত ক্রিকেট খেললাম। তারপর সব গুছিয়ে দুপুর ২:৩০ এর মধ্যে যার যার ঘরে।


1 comment: