২০ নভে, ২০১৩

সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ে।

চন্দ্রনাথ পাহাড়ে আমি বহুবার উঠেছি। যখনি মন খারাপ হয়েছে বা সীতাকুন্ডে ফুফূর বাসায় ঘুরতে যায় ওই পাহাড়ে উঠে যায় । আমি চন্দ্রনাথে উঠে মন্দিরের পাশের একেবারে খাদ ঘেসে যে পাথরের রেলিং আছে সেটাই বসে থাকতে ভালোবাসি। ভিউটা অসাধারণ লাগে দুরে সমুদ্র দেখা যায় মাঝে শহরটা ।এটা বোধহয় পাহাড়কে ভালোবাসি তাই। কিন্তু বাংলাদেশের পাহাড়ের স্বর্গ হলো বান্দরবান, যেটা আমার বাসা থেকে ৮০ কি:মি দুর আর চন্দ্রনাথ হলো মাত্র ৩৫ কি:মি দুরে। তাই চন্দ্রনাথে দিনে গিয়ে দিনে চড়ে আসা যায় বলে এ পাহাড়টার সাথে আমার একটা বন্ধুত্ব হয়ে গেছে।

প্রথম এই পাহাড়টাই আমাকে নিয়ে যায় আমার এক বন্ধু। সনজয় কুমার নাম ওর। দারুন একটা ছেলে। আজ সেই গল্পটাই লিখতে বসলাম :-

সনজয়ের কর্ণেল হাট আসার কথা সকাল ৭:৩০ এর মধ্যে। গরমের সময়। একেবারে বৈশাখ মাসের ২ তারিখ। তাই সকাল সকাল গরমটা জেগে উঠার আগেই পাহাড়ে উঠার প্লান ছিল। কিন্তু বেটা আসলো ৮:৩০ এর দিকে। কি আর করা তাকে ছাড়া যাওয়াও যাবেনা , পুরান বন্ধুটা আজ আমার গাইড ... তাই পার্ট নিচ্ছিল সে।
কর্ণেল হাট থেকে লোকাল সিএনজি পেলামনা। তাই চট্রগ্রাম শহরের মূল গেইট সিটি গেট থেকে একটা সিএনজি নিয়ে সোজা চলেগেলাম সীতাকুন্ডের কলেজ রোডের মোড়ে । এখান থেকে কিছু বিস্কিট , শুকনা খাবার আর প্রচুর পানি কিনে নিলাম আমরা। এখান থেকে টমটম বা রিক্সা পাওয়া যায় একেবারে চন্দ্রনাথ মন্দিরের উঠার আগে যে মন্দিরটা পড়ে সেই মন্দিরের সিড়ি পর্যন্ত। কিন্তু আমরা হাটা শুরু করলাম। হাত পা গুলাকে একটু প্রস্তুত করার জন্য। আমরা তখন সমুদ্রপৃষ্টে ছিলাম আর একটু পরেই ১৩০০+ ফুটের পাহাড়টাই চড়বো তাই এ ব্যাবস্থা। ১৩০০+ ফুট এমন কোন উচ্ছতানা। কিন্তু আমরা বীরুপক্ষ নামে আরেকটা পাহাড় দিয়ে তারপর চন্দ্রনাথে যাবো। পথ প্রায় খাড়া এবং পরিশ্রমের তাই হেটে হাত-পা গুলাকে একটু প্রস্তুত করা। একসময় আমরা হাটতে হাটতে জগন্নাথ আশ্রম আসলাম। খুব সুন্দর একটা প্লেস। সাপের বিশাল ফনা ওয়ালা একটা বসার স্থান দেখলাম। সীতাকুন্ডে রথ যাত্রায় ব্যাবহার করার রথ দেখলাম।
ছবি:- জগন্নাথ আশ্রম।
ছবি:- সাপের ফনাওয়ালা বেদী।
ছবি তুলে আবার হাটা ধরলাম। পথে কালী মন্দির পড়লো। তার ঠিক উল্টোপাশে পড়লো তাক তাক সিঁড়িওয়ালা একটা ছোট্ট পাহাড়। এই সিঁড়ি ভাঙ্গলে নাকি আরেকটা মন্দির আছে। আমরা উঠলামনা। নাক বরাবর হাটতে লাগলাম। একসময় এসে গেলাম শংকর মঠে।
ছবি:- শংকর মঠের গেট।
শংকর মঠের দুইটা বিশাল বিশাল সিংহের নিচ দিয়ে আমরা মঠটা দেখতে ঢুকলাম। খুবই সুন্দর একটা প্লেস। মনোরম। পরিবেশ। উপরে এক পাশে একটা মন্দির অন্য পাশে গীতা ভবন। সনজয় গেল এখানে দুপুরের খাবারের টিকিট কিনতে , এখানে শুধু সবজি দিয়ে নিরামিষ একধরণের খাবার রান্না হয় ও বলল এটা নাকি আমার চেখে দেখা দরকার। তো ও গেল পাহাড় থেকে যখন নেমে আসবো তখন পেট পুরে খাওয়ার ব্যাবস্থা করতে আর আমি ছবি তুলতে লাগলাম।
ছবি:- গীতা ভবন।
এই গীতা ভবনে কখনো গীতা পাঠ বন্ধ হয়না। এটি পাঠ চলছেই। হলুদ জামা পড়া পুরহীতদের অনুমুতি নিয়ে আমরা দোতালায় দেখে/শুনে আসলাম গীতা পাঠ। এই গীতা ভবনের পেছনেই খাবারের ব্যাবস্থা ।
ছবি:- গীতা ভবনের ঠিক উল্টোপাশেই এ মন্দির।
গীতা ভবন আর শংকর মঠ দেখে আমরা আবার সিংহ বাবাদের নিচ দিয়ে বের হয়ে হাটা শুরু করলাম পুর্ব দিকে। একটু পরেই পেলাম চন্দ্রনাথ পাহাড়ে উঠার রাস্তার মন্দির আর তার গেইট।
ছবি:- আমার গাইড সনজয় গেটের সামনে।
এগেইট দিয়ে একটু উঠে সোজা সিড়ি বেয়ে উঠলে মন্দির তারপর আবার চন্দ্রণাথে উঠার রাস্তা। আর গেইটের একটু পরে ডান দিকে সিড়ি বেয়ে নেমে গেলে সীতা গোসল করত যে ঝর্ণায় সে ঝর্ণা। তখন ঝর্ণার পানি ছিলনা। বর্ষায় এ ঝর্ণায় পানি থাকে।
ছবি:- শুকিয়ে যাওয়া ঝর্ণায় আমি।

ঝর্ণা দেখে  আমরা আবার উঠা শুরু করলাম। বিশাল একটা সিড়ি দিয়ে উঠে মন্দিরে উঠলাম। মন্দিরটাও বিশাল। ছোট আনেক দেব দেবীর মুর্তি আছে। সনজয় আমাকে ওদের নাম গুলু বুঝাতে লাগলো। আমি ছবি তুলতে লাগলাম।

ছবি:- মূল মন্দির।
ছবি:- মন্দিরের গূম্বুজ।
মন্দিরে কিছুক্ষন রেস্ট নিয়ে আমরা এবার মূল মিশনে লেগে গেলাম। চন্দ্রনাথ পাহাড়ে উঠা। এই মন্দির থেকেই মোটামুটি পাহাড়ি রাস্তা শুরু।

ছবি:- চন্দ্রনাথে উঠার সময় এরকম অনেক সিড়ি পড়বে।
আমাদের পাহাড় বাওয়া শুরু হলো। পথে একটা ঝর্ণা পড়লো। সুন্দর ঝর্ণা কিন্তু বর্তমানে সেখানে একটা বিশাল পাইপ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে মন্দিরে খাবার পানির জন্য। এই ঝর্ণার পাশেই একটা ছোট দোকান আর বসার খুব সুন্দর একটা ছাউনি আছে। ছাউনিতে বসে চা খেতে খেতে আপনি বলতেই পারেন লাইফটা খারাপনা।  কারণ চারপাশে ভিউ এত্ত সুন্দর যা লিখায় প্রকাশ করা অসম্ভব। এখনো আমরা যাত্রা শুরুই করিনি কিন্তু প্রকৃতির মাঝে এখনই হারিয়ে গেলাম।


ছবি:- অদ্ভুত দর্শণ পাহাড়। এর উপরই বীরুপক্ষ মন্দির।
ছবি:- এই সেই ছাউণী।

ওই ছাউনি কাম দোকান থেকেই আপনাকে ডিসিশান নিতে হবে আপনি বীরুপক্ষ হয়ে চন্দ্রনাথ যাবেন না। সোজা সিড়ি বেয়ে চন্দ্রনাথ যাবেন। আমরা সিড়ির লোভ ছেড়ে কাচা-পাকা আধ ভাঙ্গা রাস্তা দিয়ে বীরুপক্ষের দিকে উঠতে লাগলাম। যে সিড়ির রাস্তা চন্দ্রনাথ গিয়েছে সেটা হাতের ডান দিকে আর যেটা বীরপক্ষ হয়ে গেছে সেটা বাম দিকে।


ছবি:- এই সুন্দর সিঁড়ির লোভ ছাড়লাম। যদিও নামার সময় এটা দিয়ে নামবো।

অদ্ভুত অদ্ভুত রাস্তা দিয়ে আমরা উঠতে লাগলাম। কোথাও খাড়া পাহাড় তো কোথাও ভাঙ্গা সিঁড়ি আবার কোথাও কোন এক অন্যরকম পাথর খন্ডের পাশদিয়ে রাস্তা।
ছবি:- পাশে এরকম পাথর ফেলে উঠে চলা।
ছবি:- এই হলো রাস্তার অবস্থা।
একসময় আমরা বীরুপক্ষ মন্দীরে উঠলাম। ওঠার ঠিক আগের রাস্তাটা অসাম। দুইপাশে বিশাল বিশাল দুটো গাছ আর এই তাপদাহ রোদে ছায়া। এখানে আমরা অনেক্ষন রেস্ট নিলাম। এখানে দুটো শিব লিংগ আছে।
ছবি:- শিব লিংগ।
রেস্ট শেষে আমরা আবার উপরে উঠতে লাগলাম। রাস্তা বেশ খাড়া। কষ্ট হলো বেশ। যখন মনে হলো আর সম্ভব না এই খাড়া পাহাড় উঠা তখন মানুষের গলার আওয়াজ পেলাম আমরা। আরেকটু উপরে উঠে দেখি একটা ছাউনি আর ছোট্ট একটা দোকান মত। এখানে একেবারে শুয়ে লেটায় রেস্ট নিলাম আমরা। দারুণ বসার স্থান। অনেক উপর থেকে সীতকুন্ড শহর , বীরপক্ষ মন্দির সমুদ্র সব দেখা যাচ্ছিল। ( এ স্থাটিই একসময় আমার প্রিয় একটা বসার স্থান হলো। )


ছবি:- ছাউনি। নিছে খাদের মত। আর সেই একটা ভিউ।








 
ছবি:- বীরুপক্ষ মন্দির দুর থেকে।

এখানে থেকে মাত্র ৫-৬ মিনিট লাগলো চন্দ্রনাথে উঠতে। একদম সোজা উঠে গেছে। মন্দিরের পাশেই একটা পুলিশ ফাড়ি যারা এখানে আসে তাদের নিরাপত্তার জন্য। আমার মন্দিরে উঠে রেস্ট নিলাম। চারপাশে শুধু পাহাড় আর পাহাড়।
ছবি:- মোমবাতি একটা সমাধীর পাশেই।
 
ছবি:-  পড়ে দেখতে পারেন?

মন্দিরের পাশের রেলিংএ পা ঝুলিয়ে বসলাম আমরা। ভিউ দেখতে লাগলাম।
ছবি:- আমি চন্দ্রনাথের উপরে।
ছবি:- নিচের বীরুপক্ষ মন্দির চন্দ্রনাথ থেকে।
অনেক্ষন বসে থাকার পর আমরা এবার নামতে শুরু করলাম। নতুন পথ দিয়ে। অর্থাৎ সিড়ির রাস্তা দিয়ে। আমি ট্রেকিং বা হাইকিংএ সেম পথে ব্যাক করা পছন্দ করিনা। তাই খুশিই হলাম। আমরা উঠেছি এক পথ দিয়ে নামছি আরেক পথ দিয়ে। থ্যাংকস টু সনজয়।
নামার পথটাও খুব সুন্দর। নামার সময় দেখলাম ইকো পার্কে যাওয়ার একটা রাস্তা আছে। কিন্তু পুলিশ বসে থাকে ওখানে। কাউকে যেতে দিতে চাইনা ওই পথে।তাই আমরা সিঁড়ি দিয়ে নামা শুরু করলাম।
ছবি:- সিড়ি।
ছবি:- সিড়ি।
ছবি:- সিড়ি।
অবশেষে নিচে নেমে এলাম। যেখানে উপরে উঠতে লাগলো ১.৫ ঘন্টার মত , নামতে লাগলো আধ ঘন্টার ও কম। শেষ একবার চন্দ্রনাথ পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আমরা মন্দিরে ফেরত আসলাম। টোকেন দেখিয়ে জাম্পেশ একটা খাবার খেলাম।
ছবি:- শেষ বার দেখা ওই দিনের মত।


ছবি:- মন্দিরের ঘন্টা।
[নোট :- চন্দ্রনাথে কিভাবে যাবেনে ?

প্রথমে আপনাকে ঢাকা চট্রগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুন্ড নামতে হবে। এরপর কলেজ রোড থেকে হাটা শুরু। সোজা পূর্ব দিকে। মন্দিরে পৌছে যাবেন। রিক্সা নিতে পারেন নিচে গেইট পর্যন্ত ২০-২৫ টাকা নেবে। ঢাকা থেকে সীতাকুন্ড বাস ভাড়া ৪০০ টাকার মত নন-এসি। আর চট্রগ্রাম থেকে বাস ভাড়া ২০-২৫ টাকা। রাইডার ৩০ টাকা। সকাল ৭টা থেকেই অলংকার মোড়ে গাড়ি পাবেন।

কোথায় থাকবেন ?

চট্রগ্রাম থেকে গেলে আপনি দিনে গিয়ে দিনে ঘুরে আসতে পারেন। থাকার প্রোয়জন নেই। উল্টো ইকো পার্কে টু দিয়েও আপনি সন্ধ্যার আগেই চট্রগ্রাম ফেরত আসতে পারেন।

ঢাকা থেকে যারা আসবেন তারাও দিনেই ফেরত যেতে পারেন। সেক্ষেত্রে সকালে যখন বাস থেকে সীতাকুন্ড নামবেন তখন কাউন্টারে অগ্রিম টিকিট কেটে ফেলুন সন্ধ্যার ফিরতি বাসের। তাও যদি আশপাশে ঘুরার জন্য থাকতেই চান তাহলে দুটা উপাই আছে। এক সীতাকুন্ডে হোটেল আছে। ভালটা হলো হোটেল সাইমুন। ৩৫০-৪০০ টাকার মধ্যে ভাল রুম পেয়ে যাবেন। আর এছাড়া বোড়িং আছে।

দ্বীতীয় উপায় হলো চট্রগ্রাম চলে আসা। এ.কে.খান মোড় আর অলংকার মোড়ে প্রচুর হোটেল পাবেন।

আশপাশে ঘুরার কি কি আছে?

আশপাশে ইকো পার্ক আছে। ইকোপার্কের ভেতরে দুটা ঝর্ণা আছে। সুপ্তধারা আর সহস্রধারা। কলেজ রোড থেকে মাত্র ১০ টাকা নেবে লোকাল সিএজি ইকোপার্ক পর্যন্ত।

এছাড়া ছোট দারোগা হাটের সহস্রধারা ঝর্ণায় যেতে পারেন। সীতাকুন্ড বাজার থেকে ছোট দারোগাহাট এর লোকাল সিএনজি ভাড়া ১০টাকা।

মীরসরাই এর খইয়াছড়া , নাপিত্তাছড়া ইত্যাদি ঝর্ণায় যেতে পারেন । মহামায়া রাবার ড্যাম্প এ লেকটা ঘুরে আসতে পারেন।

কোথাই খাবেন ?

চন্দ্রনাথে উঠার সময় শুকনো খাবার , পানি কিনে নিয়ে যেতে পারেন। উপরের দোকান গুলোই দাম বেশি। আর দুপুরে মন্দির বা বাজারে ফেরত এসে খেতে পারেন। সীতাকুন্ড বাজারে ভাল হোটেল আছে। ইভেন চাইনিজ রেস্টুরেন্টও আছে। সো নো টেনশন।

শেষ কথা :- পাহাড়ে যখন যাবেন তখন যতরকম প্লাস্টিকের জিনিস সাথে নিয়ে যাবেন তা সাথে করেই ফেরত আনুন আর বাজারে ডাস্টবিনে ফেলুন। আর মন্দিরের পবিত্রতা ও পুরহিত এবং পুজা করতে আসা লোকজনকে সম্মান করে কথা বলুন/ভালো ব্যাবহার করুণ। ] 

আমার লিখা অন্যান্য ব্লগ সমূহ :- ১/ পকেট চুলা কিভাবে বানাবেন ?(হাইকিং এন্ড ক্যাম্পিং গিয়ার) ২/ সেন্টমার্টিন দ্বীপে তাবুবাস। ৩/ ক্যাম্পারভ্যানে নিজের দেশ ঘুরা দেখা।  ৪/ ভারত ভ্রমণ :- পর্ব আগ্রা ( Land of immortal Love) ৫/ সোনাদিয়া দ্বীপে ক্যাম্পিং।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন