২৫ সেপ, ২০১৩

চেনা পথে হারিয়ে যাওয়া এবং তাবুতে রাত্রি যাপনের একটি গল্প।


ক্যাম্পিং প্লানটা হটাৎ করেই। যদিও ফেসবুকে একটা ইভেন্ট দেওয়া ছিল সামার ক্যাম্পিং নামে। আমাদের প্রাথমিক প্লান ছিল প্রথম রাত আমরা সীতাকুন্ডের একটা ঝর্ণার পাশে ক্যাম্প করবো , বারবিকিউ করবো। এবং দ্বিতীয় রাতটা আমরা মহামায়া লেকে ক্যাম্প করে কাটাবো।

যতটুকু সম্ভব কম ট্রেকিং এর চিন্তা ছিল। কারণ আবহাওয়া প্রচন্ড গরম ছিল। গরম কালের একেবারে শুরুর সময়। এতই গরম পড়তেছিল যে ১০-১৫ মিনিটও রোদে দাড়িয়ে থাকা যেতনা। চলুন গল্পটা পড়ি :-


(সীতাকুন্ডের এ ঝর্ণাটা টুরিস্ট হট স্পট হয়ে লোকজনের ফেলে আসা প্লাস্টিকের বোতল , পলিথিন , ময়লায় ভরে যাবে এ চিন্তার কারণে লোকেশনের ঠিকানা দিলামনা। আর কমেন্ট বা মেসেজে প্রশ্ন করেও লাভ নেই। আমি ওয়াদা বদ্ধ কিছু গ্রুপ এবং ভ্রমণ বন্ধুদের এবং নিজের কাছে লোকেশন না দেওয়ার পক্ষে। এখানে অবশ্য মূল ঝর্ণার কোন ছবি দেইনি , আর ছবির কোয়ালিটির জন্য দু:খিত। সব ছবি মোবাইলে তোলা। )

১৩-এপ্রিল-২০১৩
-----------------------------------------------------------------------------
সকাল সাড়ে ৭টার মধ্যে সবার অলংকার আলিফ হোটেলের সামনে আসার কথা ছিল। সবাই বলতে আমি , সাকিব , মামুন ভাই আর জুমন ভাই। সাকিব সবার আগে এলো।
এরপর একে একে জুমন ভাই আর মামুন ভাই। আমরা প্রথমে সীতাকুন্ডের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। বাজারে নেমেই আমি আর জুমন গেলাম কাচা বাজারে। মামুন ভাই আর সাকিব গেল একটা হোটেলে নাস্তা সারতে। আমাদের ভারী ব্যাকপ্যাক গুলা মামুন ভাই আর সাকিবের জিম্মায় রেখে আমি আর জুমন ভাই প্রথমে মুরগী কিনতে গেলাম। মুরগী চার টুকরা করে পিস হলো বারবিকিউর জন্য। আর কিছু গাজর শসা কেনা হলো সালাদের জন্য। অন্যান্য জিনিস আমরা চট্রগ্রাম থেকেই নিয়ে এসেছি।

যাত্রা শুরু হলো প্রচন্ড গরমে। হেটে হেটে ঝর্ণায় যেতে আমাদের ১২টা বাজার অবস্থা। এ ঝর্ণায় আমি এর আগে আরো ২-৩ বার এসেছি। সাকিব ছাড়া বাকিরাও আগে একবার করে এসেছে। চেনা পথ। কিন্তু ঝিরিপথ গুলা বর্ষায় একরকম আর গরমে শুকিয়ে আরেক রকম। আমরা অনেক্ষন হাটার পর যখন নিদৃষ্ট পথটা পেলামনা , বুঝলাম আমরা পথ হারিয়েছি। খুব অবাক লাগলো। এত্ত সোজা ট্রেইলে পথ হারালাম ? এর আগে যখন বর্ষায় এসেছিলাম তখন একপ্রকার চোখ বন্ধ করে হেটে চলে গিয়েছিলাম ঝর্ণায়। তো আকা বাকা অনেক ঝিরি পার করলাম। কিন্তু পথ পেলামনা। আরে ফেরার পথও গুলিয়ে ফেলেছি আমরা। তখন দুপুর ১টা বাজে ঘড়িতে। জান বের হয়ে যাওয়ার অবস্থা। সাথের পানিও শেষ। শেষে আমি আর জুমন মিলে উচু টিলাগুলাই উঠে উঠে পথ খুজলাম। পেলামনা। আমরা বুঝলাম বিপদে পড়েছি।  এত্ত গরম আর যে ঝিরিতে কয়েক মাস আগেও ১ হাটু পানি ছিল সেটা এখন খটখটে শুকনো। একজায়গায় দেখলাম আগুনে পুরা একটা পাহাড় ঝলসে গেছে। আমরা শেষ একটা স্থানে এসে মনে করলাম এটাই হইতো সেই পথ। কিন্তু পথ ভুল হওয়ার ভয়ে ভেতরে ঢুকলামনা আর । এক প্রকার হাল ছেড়ে দিলাম আমরা , জুমন ভাই একটা টিলা মতন স্থানের উপরে উঠে দেখে এসে বলল সজল ভাই আমার মনে হয় এটাই সেই পথ ঝর্ণায় যাওয়ার তারপরেও আমরা রিস্ক নিলামনা। ফিরে মহামায়া লেকে ক্যাম্প করার প্লান পাকাচ্ছি। এমন সময় জংগল ফুডে যেন একটা কাঠুরে বা স্থানিয় লোক বের হয়ে এলো। আমাদের প্রাণে প্রান ফিরে এলো , লোকটার সাথে কথা বলে পথের দিশ নিশ্চিত করলাম। আর আমরা এগিয়ে চললাম নতুন উদ্দমে। পানির পিপাসা , ক্ষুদা , গরম সব ভুলে।
ছবি:- সব পুড়ে গেছে।
ছবি:- শেষে পথটা পাওয়া গেল।

ছবি:- এ স্থন গুলার সবুজ ছবি আছে আমার কাছে। কিন্তু সব এখন অন্য রকম।
আমরা এতক্ষনে ঝিরিতে কোন পানি না দেখে , খটখটে শুকনো পরিবেশ দেখে পুরাই হতাশ হয়ে পড়ে ছিলাম। কারণ এ ঝর্ণার ঝিরিতে আগে যতবারই এসেছিলাম ততবারই প্রচুর পানি ছিল। এখন একেবারে শুকনো। গরমে কাহিল। হটাত করেই মূল ঝর্ণার ঝিরিটাতে এলাম আমরা আর একটু আধটু পানির চিহ্ন পেতে লাগলাম। চলার শক্তি দুই গুন হয়ে গেল আমাদের সাথে সাথে।
ছবি:- ঝিরি পথে হাটা হাটি।
ঝিরিতে পানি দেখেই মনটা সবার ফুরফুরে হয়ে গেল। পায়ে ঠান্ডা পানির ছোয়া এ গরম পরিবেশে অত্যান্ত আরম দায়ক। একসময় আমরা মূল ঝর্ণার সামনে চলে এলাম।
ছবি:- মূল ঝর্ণার সামনে আমরা। সামনেই জংগলের ওপাশে ঝর্ণাটা।
ক্লান্ত আমরা অনেক্ষন বসে রেস্ট নিলাম ঘুমন্ত ঝর্ণাটার সামনে । এই ঘুমন্ত ঝর্ণাই বর্ষা কালে রাগে ফুসে উঠে। তার গর্জন বহু দুর থেকে শুনা যায়। হটাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠি আমি। ক্যাম্প সাইট খুজার পালা। ঝর্ণার উপরেই একটা সমান পথর মত স্থান আছে। তিনটা তাবু ফেলানো হলো। যদিও আমরা মাত্র ৪ জন। আমার তাবু ফেল্লাম ঘাস মত স্থানে। নিচে ঘাসগুলো গদির আরাম দিচ্ছিল।

ছবি:- আমাদের ক্যাম্প সাইট।
ক্যাম্প সেট করেই আমি রান্নায় লেগে গেলাম। স্টোভে ফুয়েল দিয়ে রান্না শুরু হলো। যেহেতু দুপরে কিছুই খাইনি আমরা সুপ আর নুডুলর্স খেলাম। খেয়েই পানিতে ঝাপ। আধো আলো আধো অন্ধকারে গোসোল করে রাতের খাবার আর বারবিকিউ এর প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। আর শুকনো সময় হওয়াই পানির সংকট। ঝিরিতে প্রচুর পানি থাকলেও ওই পানি খাওয়া নিরাপদ না এ সময়। তাই একটা স্টোভে খালি পানি ফুটছে আর তা বোতলে ভরতি করতে লাগলাম।
ছবি:- রাতের রান্না চলছে।
ছবি:- বারবিকিউ প্রায় রেডি।
সব শেষে যখন খাবার রেডি হলো আমরা ঝাপিয়ে পড়লাম। আমার হেব্বি মজা লেগেছিল , বাকিদেরটা জানিনা। 

ছবি:-  রাতের খাবার। বারবিকিউ ওইথ বাকর খানি। ডেজার্ট তো আছেই।
খাওয়া দাওয়া পরেই দেখা গেল ক্লান্তি আবার ফিরে আসছে। প্রচুর ধকল গেছে আজ। আমি আর সাকিব সব ধুয়ে পরিস্কার করে আর একটা সেকেন্ড দেরি করলামনা। ঘুমাতে গেলাম। আমি ১০ মিনিটেই ঘুমিয়ে গেলাম। একলা ছিলাম তিনটে তাবুর একটাতে। অন্য একটাই জুমন , সাকিব আর মামুন। আর খালি তাবুটাই ব্যাগ , জিনিস পত্র। ঘুম ভালোই হতো , কিন্তু আধা রাতে জুমন ভাইর ডাকা ডাকি ... সজল ভাই আমাদের তাবুতে কে জেন ঢিল মারতাছে। আমি ভুতে বিশ্বাস করিনা। বললাম/বুঝালাম এখানে প্রচুর ব্যাঙ আছে তাদের রেগুলার চলার পথে আমরা তাবু ফেলেছি। তাই তারা হয়তো তাবুর কাপড়ের উপর লাফিয়ে পড়ছে। আবার ঘুমাতে গেলাম।

১৪-এপ্রিল-২০১৩
-----------------------------------------------------------------
ঘুম ভাংলো আনেক দেরিতে। সকালের সুর্য তখন জেগে ওঠছে।
ছবি:- সকালের আলোয় পুরা ক্যাম্প সাইট।
ছবি:- স্টোভে রান্না হচ্ছে আর আমি ভাবি , রাতে কই ছিলাম ?
ছবি:- সকালের নাস্তা।

নাস্তা তো খাওয়া হলো। এখন একটু সাইট ঘুরে দেখা যাক। যে ঝরনায় এর আগে পানির তোড়ে এগোনো কষ্ট ছিল সেটা দৌড়ে দেখা যাচ্ছে এ খরার সময়। সব রেখে খালি ক্যামেরা হাতে নিয়ে হাটা শুরু করলাম। উদ্দেশ্য চারপাশটা একটু ঘুরে দেখা।


ছবি:- বৃষ্টির দিনে এখানেই জল আর পাথরের মিলন হয়।
ছবি:- এটাও একটা ঝিরি ।
ছবি:- আমি। প্রকৃতি দেখি।
ছবি:- বর্ষায় এটা কিন্তু সে রম প্লেস হয়।


ছবি:- সামনের এই পানিটা কিন্তু খুব গভীর।

ছবি:- একটা খুমের মত।

অনেক দেখা হলো এদিক সেদিক। ইচ্ছে ছিল আমরা আরো ভেতরে যাবো। ভেতরে আরো অনেক ঝর্ণা আছে কিন্তু সময় কখন গড়িয়ে গেছে বলতেও পারবোনা। আমাদের আবার মীরসরাই যেতে হবে মহা মায়া লেকে গোসোল করতে হবে। তাই কিছু পানি ফুটিয়ে নেওয়া হলো। তারপর যাত্রা আবার শুরু।
ছবি:- পানি ফুটানো হচ্ছে।


ছবি:- গরমে চলছে ট্রেকিং। জুমন দি গামসা মেন।
আমাদের মধ্যে মামুন ভাইয়ের বেশি কষ্ট হচ্ছিল । বেচারার পান খাওয়ার দৃশ্য এখনো আমার মনে পড়ে। পিপাষা কাকে বলে হাড়ে হাড়ে টের পাইছি আমরা।
ছবি:- মামুন ভাই পানি খাচ্ছে।
একসময় আমরা আবার লোকালয়ে পৌছালাম। বাস ধরে ঠাকুর দিঘী বাজার এবং তারপর কিছু মাছ আর বাজার করে মহামায়া লেকে। উদ্দেশ্য লেকের উপর একটা পাহাড়ে ক্যাম্পিং।

ছবি:- মহামায়া লেক।
ছবি:- লেকের মূল বাধ।
ছবি:- এর পর শুধুই উঠা।
 লেকের পাশের পাহাড়ে ট্রেকিং মহা কষ্টের ছিল। সাথে ছিল আরো ভারী ব্যাগ। ওপরে ওঠে মাছ গুলো পরিস্কার করলাম। জুমন , মামুন ভাই আর সাকিব অনেক্ষন লেকের পানিতে সাতার কাটলো , পনিতে সাতারের রেস করল।
ছবি:- দুপুরের খাবার। মাছ ভাজি আর পোলাউর চালের ভাত।

ছবি:- পাহাড়ের উপর থেকে লেক।


জীবনটা আসলেই খারাপনা।

এখানে সকল ছবির ক্রেডিট মামুন ভাই এর মোবাইল আর জুমন খানের তোলার।

[ নোট:- ক্যাম্পিং , হাইকিং এবং  ট্রেকিং এ গেলে পরিবেশের প্রতি খেয়াল রাখবেন। ময়লা আবর্জনা নিদৃষ্ট স্থানে ফেলবেন। 

মহামায়া ছাড়া অন্য জায়গাটার বিস্তারিত কিছু আমার অন্যান্য লিখার মত লিখলামনা বলে আমি অত্যান্ত দু:খিত ]

আমার অন্যান্য লিখা :- ১/ সেন্ট মার্টিনে ক্যাম্পিং ২/ ছেড়া দ্বীপে ক্যাম্পিং ৩/ সোনাদীয়া দ্বীপে ক্যাম্পিং । সহ এই ব্লগে আরো রিখা পাবেন ভ্রমণ বিষয়ে। 

৫টি মন্তব্য:

  1. bro block ta jokon likai fallen...thahola ak sathe jornar tikanatao dea ditan....

    উত্তরমুছুন
  2. ভালো হয়েছে। ভালো লাগলো পড়ে।
    পরিবেশ সচতনতা প্রশ্নে একমত। তবে, "ময়লা আবর্জনা নিদৃষ্ট স্থানে ফেলবেন" এতটুকু বলে দেয়া যথেষ্ট হয়নি বলে মনে করছি। পাহাড়ে-জঙ্গলে 'যথাস্থান'-টা আসলে কী, সেটা বুঝিয়ে বলা যেত যে, সেটা আসলে 'নিজের পকেট' এবং 'ব্যাক-টু-ঢাকা'।

    চলুক!

    উত্তরমুছুন