প্রথমবার
বান্দরবানের এ ট্রেইলে যেয়ে বিশেষ সুবিধা করতে পারিনি। তাই আবার যাওয়ার প্লান
করলাম। তবে
এবারের প্লানেও “বাগ”
ছিল , কেউ কোন সামিট করুমনা এবং ঝর্ণায় গোসোল করুমনা একটা ভাব নিয়া রওনা দিসিলাম। এবারের
দল হলো মামুন ভাই , হাসান ভাই , জুমন ভাই ,সৈকত ভাই আর রুপা দি।সাথে আরো যুক্ত হলো
আমাদের বিদেশি বন্ধু স্লোভাকিয়ার নাগরকি ইয়ান কিরিকিস আর জাপানি মেয়ে এমেলি।সব
প্লান হওয়ার পর আমরা একদিন হুট করে হারিয়ে গেলাম বান্দরবানে। ট্রিপটা অসাধারণ ছিল।
যেখানে আমরা ভেবেছিলাম ফেব্রুয়ারির ঠান্ডায় ঝিরিতে বা খালে পানি থাকবেনা সেখানেও
দেখলাম যথেষ্ট পানি। আর সারাদিন গরমে জিহব্বা বের করে পাহাড়ি কুকুরের মত পাহাড়
বাওয়া সন্ধ্যায় যেখানে খুশি সেখানে তাবু খাটিয়ে আগুনে রান্না করে ঠান্ডায় কাঁপতে ঘুমানো
স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে। ভোরের ঠান্ডায় জমে যাওয়া ক্ছপের মত ধীর গতিতে নড়া চড়া করা।
দিনে যেমন খুশি তেমন ভাবে লেটানো চিপায় চাপায় আর পাড়া বেড়ানো। শেষের দিন ঝড় তুফান
, প্রচন্ড বৃষ্টি মাথায় করে চট্রগ্রাম ফেরত আসা। এক ট্রিপে মোটামুটি বাংলাদেশের সব
আবহাওয়ার মজা নিতে নিতে ৪ দিন কোনদিকে বেরিয়ে গেল আমরা টেরই পেলামনা। পুরো ভ্রমন
লগটি নিচে লিখার চেষ্টা করলাম। একটু বড় আর বিরক্তকর হয়তোবা,কিন্তু লগতো ... আশা
করি ভালো লাগবে :-
-----------------------------
সন্ধ্যা
৭টায় আমি জিইসি মোড়ে দাড়িয়ে আছি কাধে ইয়া বড় একটা ব্যাকপ্যাক নিয়ে। কোমরে থ্রি
কোয়াটার প্যান্ট। টুরিস্ট টুরিস্ট পুর্ণ ভাব। যারা চট্রগ্রাম থাকেন তারা সবাই
যানেন চট্রগ্রামের সুন্দরীরা বেশির ভাগ সময় সেন্ট্রাল প্লাজা আর আসপাশে থাকে। আমিও
একেবারে সেটার সেন্টারে দাড়িয়ে আছি। পার্টে আছি। কারণ সামনে দিয়ে যাওয়া সকল তরুণী
একবার অন্তত আমার দিকে তাকাচ্ছে। হোকনা সেটা আমার টুরিস্ট টুরিস্ট অদ্ভুত লুকের
জন্য বা ব্যাকপ্যাকের জন্য। আমিও তাদের
দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসছিলাম। আহা সময়টা ভালই কাটছিল। মোবাইলে টুং করে এসএমএস
আসলো আর দেখি যে বেটার জন্য আমি ঠাই রাস্তায় দাড়িয়ে আছি সেই ইয়ান এসএমএস দিয়েছে, তার
দেরি হবে একটু , মাথাটা গরম হয়ে গেল। বেটা অলওয়েজ লেট। গতকাল পুরাটা দিন তার পেছনে
ওয়েস্ট হইছে হেডল্যাম্প , ক্যাম্পিং এর ফুড প্যাক এসব কিনতে কিনতে।
পাক্কা
আধঘন্টা পর ইয়ান এলো। প্রথমে ভাবসিলাম বাসে যাবো নিউ মার্কেট। পুরা বাস খালি,কিন্তু
বাসে আমাদের জায়গা হলোনা। স্লোভাকিয়ার ইয়ান প্রায় ৭ ফিট লম্বা। বাংলাদেশের লোকাল
বাসের ভেতরে উপরদিকে একটা কি দুটো ছোট জানালা থাকে। তার মাথা ওদিক দিয়ে বের হয়ে
যায় পুরা দাড়ালে আর , সে ওখান থেকে বলে “সোহরাব আই গট আ নাইস ভিউ ফ্রম আপ হিয়ার।“
সিটে ট্রাই মারলাম তার পা আমাদের লোকাল বাসের উপযুক্ত না। একটা ঢুকে তো আরেকটা
ডুকে না। তো রিকসা নিয়ে নিউ মার্কেট রওনা দিলাম। রিকসায় বেটার আরেক কাহিনি,
রাস্তায় সুন্দরী কোন মেয়ে দেখলেই হই হই চিৎকার তার,রিকসায় দাড়িয়ে যায় প্রায়। মেয়ে
গুলো ভয় পেয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে।আর সে বলে “তোমাদের দেশের মেয়েরা কিন্তু খুব সুন্দর
সোহরাব।“ আমি শুকনো মুখে একটু হাসি।
এত
কাহিনি করে নিউ মার্কেট এসে শুনি নতুন ব্রিজ যাওয়ার রাস্তা বন্ধ আর টিমের একমাত্র
সাকাহাফহং জয়ী আর পশ্চিম বাংলার সান্দাকফু জয়ী হাসান ভাই সবার আগে ব্রিজ জয় করে বসে
আছেন আর সামটি পয়েন্টে ঝিমাচ্ছেন। আমি আর ইয়ান হেটে হেটে রওনা দিলাম।কোতয়ালীর
মোড়ের একটা ইলেকট্রিক রিকসা এসে দুজনকেই মেরে দিল। রাম্তার মাঝখানে আমরা চিৎপটাঙ।
ইয়ান আর আমার ব্যাগ ছিড়ে গেল। সে ব্যাগ দেখেই কান্না কান্না চোখে বলতে লাগলো
ব্যাগটা আমার লাইফ , গত ৬ মাস ধরে এই ব্যাগ আমার ঘরবাড়ী। ছিড়ে গেল। আর আমি দ্রুত
উঠে চারপাশ দেখে মুখ ফসকে বলে ফেল্লাম “কেউ আমাদের পড়তে দেখেনি”
শুনে ইয়ান চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো। প্রশ্ন করলো এটা কেমন কথা ? দেখলে কি? আমি
বললাম “বাংলাদেশে
X করলা গাড়ির
নিচে পড়ে মরাটা সম্মান। আর রিকসার নিচে পড়ে মরলে মানুষ ছি: ছি করবে।
আমরা নতুন ব্রিজ এসেই হাসান ভাইয়ের সাথে দেখা করলাম। চা , খাজা ভাজা খেলাম। ইয়ান তো চা পেয়ে এত্ত খুশি। একটু পরে লেট লতিফ মামুন ভাইও হাজির। বেচারা বোধহয় ভর সন্ধ্যায় ঘুম থেকে উঠে আসছে। চায়ের দোকানে ঢুকেই বাঁশের সাথে হেলান দিয়ে আবার ঘুম। এদিকে রুপা মিয়া আর সৈকত ভাইয়ের দেখা নেই। জুমন আর এমেলির তো কথাই নেই।
ছবি:- চা পান করে সে কি খুশি। |
আমি আর ইয়ান কর্ণফুলী নদী দেখতে গেলাম। রাতের কর্ণফুলী খুবই সুন্দর , প্রচুর বাতি জ্বলে জ্বল জ্বল করে কালো পানিতে। এটা আমার কথানা। আমরা নদী দেখে যখন ফেরত আসলাম তখন প্রায় সবাই চলে এলো। রুপা দিদি বোধনের প্রোগ্রাম থেকে আসছিল বোধহয়,সাথে সৈকত দাদা।এমিলি আর জুমন রোমান্টিক একটা সিএজি যাত্রা শেষ করে আসলো। আমাদের প্রথম ডেসটিনেশান মামুন পাড়া। কারবারী মামুন তো সাথেই আছে। তো মামুন ভাইর বাড়ী যাওয়ার জন্য আমরা দুটা সিএনজি নিলাম। বেচারাকে আমরা বহুত পেইন দি। তার সুন্দর পুকুর আর বাগান ঘেরা গ্রামের বাড়ীটাকে আমরে টুরিস্ট সাইট বানিয়ে ফেলছি।প্রায়ই ক্যাম্প করতে যাই ওখানে,মুরগী-টুরগী পুড়িয়ে খেয়ে ফেলি। ১ ঘন্টার সিএজি যাত্রার পর সিএজি একজায়গায় এসে আটকে গেল।আমরা চাদের আলোয় হাঁটতে হাঁটতে মামুন ভাইর বাসায় হাজির হলাম রাতের ১০:৩০ টায়।বিশাল বিশাল পুকুর দেখে ইয়ানের মাথা খারাপ। সে কোন মতে তাবু ফেলে , বড়শি নিয়ে রেডি মাছ ধরতে সারা রাত মাছ ধরবে। মামুন ভাইর আম্মা এত রাতে জেগে থেকেও আমাদের চা নাস্তার ব্যাবস্থা করে দিলেন। আমরা পুকুর পাড়ে চাদের আলোর নিচে বসে বসে চা খেলাম আর আড্ডা দিলাম। সাথে ইয়ানের মাছ ধরা দেখতে লাগলাম।
ছবি:- ফুলমুনের আগের মুন। |
১২/২/২০১৪
-------------------------------
সকাল বেলা মিনিমাম ৬টায় আমাদের বের হয়ে
যাওয়ার কথা উদ্দেশ্য বান্দরবান যাওয়। আমার ঘুম ভাংগতেই মনে পড়লো আমি মামুন ভাইর
বাসায় আছি পটিয়ার জঙ্গল খাইন নামে একটা জায়গায়। হাত ঘড়ি দেখলাম রেডিয়ামের আলোয়
দেখি ৭টা । ধড়মড়িয়ে উঠতে গেলাম দেখি জুমন আমার উপ্রে পা দিয়ে ঘুমায় আর মামুন ভাই
জুমনের উপর, ভাগ্গিস কেও দেখেনাই বা ফটো তোলেনাই নইলে মানুষ ওটা সন্দেহ করে আমাদের
মুখে চুন কালি দিত,আব্বা আম্মার আমাকে বিয়ে দিতে কষ্ট হয়ে যেত । ৭টা বাজেও চারদিকে
অন্ধকার। বাইরে দেখে মনটাই ভাল হয়ে গেল। ১০ হাত দুরের কিছু দেখা যায়না। ঘন কুয়াশা
আর কোথায় যেন মুরগী ডাকতেছে। গ্রামের একটা গন্ধ। মামুন ভাই খুব লাকি।
আমি উঠে সবাইরে ঠেলা ঠেলি করে জাগিয়ে দিলাম।
কোনমতে আমরা মামুন ভাইর হাউস মেইডের রান্নাকরা নডুলর্স আর চা খেয়ে ব্যাগ গুছিয়ে
রওনা দিতে প্রস্তুত হলাম। বাইরে তখনো ঘন কুয়াশা। আমার ক্যামেরাটা টা বের করে ফটো
তুলতে দেখি সেটা নষ্ট হয়ে বসে আছে ট্রিপের শুরুতেই , এখন সাথের সনি এরিকসন
মোবাইলটাই ভরসা।
গ্রাম্য রাস্তা দিয়ে হেটে হেটে আমরা পটিয়া
বাজারে আসলাম। কিন্তু কোন গাড়ি খালি নেই বান্দরবান যাওয়ার জন্য। প্রতি ১০ টা বাসের
৯ টাতে মাইক লাগানো। সেই সাউন্ডে বাজনা বাজছে । সব পিকনিকের গাড়ি। রিজাভর্ড আর
কর্কসবাজার যাচ্ছে। তো শেষ মেষ একটা সিএজি টেম্পু পাওয়া গেল দোহাজারী পর্যন্ত সবাই
ভেতরে ডুকে গেলাম কিন্তু ইয়ান ডুকলোনা।সে বাইরে দাড়িয়ে ঝুলে ঝুলে “দোহাজারি” “দোহাজারি”
বলে মানুষ ডাকতে লাগলো। আর টেম্পোর সত্যিকারের এসিস্টেন্ট ভেতরে বসে গপ্প মারতে লাগলো
আমাদের সাথে। প্রচুর শব্দ আর প্রিমিয়াম রাশের পর আমরা দোহাজারি পর্যন্ত আসলাম।
এবার সিএজি দেখার পালা , অনেক কষ্ট করে দুটা সিএজি পেলাম কেরাণী হাটের জন্য। এরপর
সেখান থেকে মাইক্রো বাসে চকরিয়া । অর্থাৎ চট্রগ্রাম থেকে চকরিয়া যেখানে এক বাসে
আরামসে আসা যায় সেখানে আমরা কত্তগুলা গাড়ী পরিবর্তণ করে আসতে হলো।এরপর আরামের
রাস্তা। একটা ৪ হুইলার জিপে (চান্দের গাড়ী) ঢুকে পড়লো সবাই আমি আর হাসান ভাইর জায়গা হলোনা। আমরা দুই ভাই
উপরেই বসলম। গাড়ি ছাড়লো আর পথে পথে মাল তুললো। আমরা কোনমতে উপরে লটকে ছিলাম। তবে
রাস্তাটা সেরকম। দুই পাশে বড় বড় শুকনো শরতের পাতা ঝড়া গাছের বাগান আর পাহাড়ে ঘেরা,যেন
আমরা বলিউডের কোন ফিল্মের রাস্তায়। হটাত হটাত রাস্তায় বেবুন এর মত দেখতে প্রজাতির
বানর আর পাখি,সেই পরিবেশ।
ছবি:- পাতা ঝড়া গাছের সারির মাঝ দিয়ে রাস্তা। |
ছবি:- ট্রেইলে হাটা শুরু। |
ছবি:- উপর থেকে দেখা যাই ঔই যে আলিকদম। |
আমরা রেস্ট নিয়ে নিয়ে হাটা শুরু করলাম। এত্ত
গরম পড়ছিল যে সামান্য পথ যেতে আমরা কাহিল হয়ে যাচ্ছিলাম। প্রচুর পরিমানে পানি খেতে
খেতে পানির রসদও প্রায় শেষ। আমি হাটতে হাটতেই একটা জুম ঘর খুজছিলাম। শেষ বার যখন
এসেছিলাম তখন এই জুম ঘরের কিছু বাচ্চার ছবি তুলে ছিলাম। শেষ বারের ট্রিপে যত
পোট্রেট তুলেছিলাম সব প্রিন্ট করে নিয়ে আসলাম। উদ্দেশ্য মালিকদের হাতে দিয়ে দেব।
কিন্তু জুম ঘর পেলাম ঠিকই কিন্তু শুন্য কেউ কোথাও নেই। জুম ঘরটা পরিত্যাক্ত এখন
মাত্র কিছু মাসের ব্যাবধানে। তো আমরা জুম ঘরে বসে অনেক্ষন রেস্ট নিলাম। কেউ ফটো
তুলল , কেউ কিছুক্ষন ঘুমালো। আর আমি জুম ঘরের দেয়ালে ফটোটা সাটিয়ে দিলাম,যেহেতু
মালিক কে পেলামনা। এ কাজে রুপা দি আর ইয়ান আমাকে হেল্প করলো।
ছবি:- জুম ঘরে সেটিয়ে দেওয়া ছবি। |
ছবি:- দুষ্ট ছেলের দল। |
এরপর আর কি আবার পথ চলা। এ ট্রিপে আমরা
প্রথমে রুপাদি কে পচাতে পচাতে চলতে লাগলাম। কারণ খালি খালিতো হাটা যায়না। কিন্তু
উনিকে পচিয়ে আরাম নেই যত যাই বলিনা কেন বেচারি রাগেনা। উল্টা হাসে। তাই সবই মিলে
জুমনকে পচাতে লাগলাম। বেচারা সেই খেপে। প্রচন্ড রাগ করে। কিন্ত বুক ফাটে তো মুখ
ফুটে না অবস্থা। এদিকে হটাত খেয়াল হলো আরি মামুন ভাই কই ? নাহ বেচারা হারিয়ে
যায়নাই। সাথেই আছে। হাটছে , সুযোগ পেলে ঘুমোয় আর চুপ করে সবার কথা শুনে।
ছবি :- এই সেই পাহাড়ি রাস্তা।
|
পথে আমরা একবার পথ হারালাম। দোষটা টিমের
ক্যাপ্টেন হয়ে আমারই। আমিই ভুল পথে চলে গেলাম। অনেক ডিসিশান , পায়ের ছাপ থেকে
সিদ্ধান্ত নেও হলো আমরা কোন পথে যাবো। এদিকে মোবাইলে শুধু গ্রামীন ফোনে এক-দু দাগ
নেটওয়ার্ক ছিল,তাই ঢাকায় দিনের ৫টা বাজেও ঘুমন্ত তপন দাকে রুপাদি ফোন করে কিছু
টিপর্স নিয়ে নিল। এর পর আমরা হারিয়ে গেলাম নেটওয়ার্কর বাইরে। পানি নেই , ক্লান্ত
আর গরম ... আর সন্ধ্যা এই এলো বলে। সবারই খালি তখন আমার দিকে তাকিয়ে একটাই প্রশ্ন
আর কতদুর খাল দেখতে? কই হেড ম্যান পাড়া? ... টিমের বর্তমান প্রধান হিসেবে একটু টেনশন
থাকলেও সবাইরে অভয় হাসি দিলাম। আর কানা চোখে টিমের মহিলা ক্যাপটেন রুপা দির দিকে
তাকিয়ে আমি ভরসা নিলাম।
অবশেষে কঠিন একটা রাস্তা পেড়িয়ে আমরা খালের
একটা সোর্স দেখতে পেলাম উপর থেকে। জানতাম ওটা টোয়াইন খাল না। যাস্ট একটা ঝিরি যেটা
টোয়াইন খালে গিয়ে পড়ছে। ওই যথেষ্ট । একটু পানি খেয়ে আর কেউ কেউ বেশ কিছু পানি
ত্যাগ করে রওনা দিলাম। ঝিরি , পানি আর যখন বুঝলাম সামনেই টোয়াইন খাল গতি বেড়ে গেল
সবার।
একসময় টোয়াইন খালে এসে পড়লাম আমরা আর যেখানা
বর্ষা কালে কাদা মাটি দেখছিলাম সেখানে দেখি পুরু দস্তুর বালির বিচ। কর্কসবাজার
থেকেও সুন্দর বালুর ঢিপি। এমিলি না ইয়ান তো গুনতেই লেগে গেল একটা কর্কসবাজার ,
দুইটা কর্কসবাজার। পথে হেড ম্যান পাড়া পড়লো , কিন্তু আমি আর রুপা দি মিলে
সিদ্ধান্ত নিলাম যে রাতে কিছু দুর ট্রেক করবো। সবাই মোটামুটি রাজি। খালি আমাদের
বড়ি বিল্ডার জুমন হা হা করে শ্বাস নিচ্ছে । হাসান ভাইতো পারলে আজই রুংরাং উঠে যাই,
লোকটা বাসায় কি খায় আল্লাহ ই যানে। এমিলিকে দেখলে মনেই হবেনা কোন পরিশ্রম হয়েছে
তার । মামুন ভাই তো আমাদের পেছনে পেছনে জাহান্নামে যেতেও রাজি মনে হয়। একটা টু
শব্দ পর্যন্ত নেই তার। আমরা যার যার হেড ল্যাম্প আর টর্চ বের করে রাতে ট্রেক করা
শুরু করলাম। সেই মজার ট্রেক। খালে টর্চ মেরে মেরে হাটু পানিতে রাতের নিশব্দে হাটা।
পথে এক জায়গায় বিশাল একটা আগুন দেখে যায় দেখি স্থানিয় কিছু কাঠুরে রাতের জন্য
ক্যাম্প ফেলছে। আর তাদের পাশেই আমাদের জন্য বিশাল একটা জায়গা , ঝুপ করে সিদ্ধান্ত
নিয়ে আমরা তাদের পাশেই ক্যাম্প করে ফেল্লাম। ক্যাম্পফায়ার রান্না আর আড্ডা।
ছবি:- ক্যাম্প ফায়ার। |
ছবি:- রাতের ক্যাম্প সাইট। |
রাতে আমাদের খাওয়ার আইটেম ছিল খিচুড়ি । আর
এমিলি খুব মজার কিছু জাপানি নুডুলর্স খাওয়ালো।
সবাই ঘুমাতে গেলে আমি রুপাদি আর সৈকত দাদা
গল্প করতে লাগলাম। যখন বুঝলাম বাকিদের আমাদের গল্পের আওয়াজে ঘুমাতে সমস্য হচ্ছে
তখন আমিও ঘুমাতে গেলাম। আমার টেন্ট পার্টনার ছিল হাসান ভাই। ঝিরির কল কল আওয়াজ
শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে গেলাম নিজেও জানি না।
১৩ /০৪/২০১৪
------------------------------------
সকালে কিসের শব্দে যেন ঘুম ভেঙ্গে গেল।
টেন্টের বাইরে কে যেন হাটছে। একটু ভয়ই পেলাম। কারণ তখনো চারদিকে কুয়াশা আর আধো
অন্ধকার। তাবু
তে ফ্লেয়ার না লাগিয়েই ঘুমিয়েছিলাম , তাই মাথা তুলতেই দেখি তাবুর নেটে কে যেন না
লাগিয়ে ভেতরে দেখছে। চমকে উঠলাম। নাহ MNP এর সদস্য না। কিছু দাদা কাছের গ্রামের। তারা
আমদের অদ্ভুত কান্ড কারখানা দেখছে। আমি টেন্টের জিপার খুলে বের হতেই দেখি তারা
দুরে দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছে। আমি সকালের চা করে খেয়ে নিলাম। টয়লেট সেরে আসলাম।
কিন্তু তখনো কাউরে উঠতে দেখলামনা। বাইরে তখন প্রচন্ড ঠান্ডা। ইয়ানের ওয়েদার মিটারে
দেখলাম ১৫-১৬ ডিগ্রি।
ক্যাম্প ঘুছিয়ে ফেল্লাম। কোন ময়লা বা
প্লাস্টিক জাতীয় যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এমন কিছু ফেলে এলাম না। সব রুপাদির
ব্য্যাগের সাইড পকেটে চালান হয়ে গেল।একে একে যখন সবাই উঠলো ফটাফট ছবি তুলে আমরা
রওনা দিলাম নাস্তা না করেই। সামনেই তো একটা বাজার আছে। সেখানে নাস্তা করে নেওয়া
যাবে এমন উদ্দেশ্য।
ছবি:- সকালের ক্যাম্প সাইট। (ফটো ডেবিট হাসান ভাই) |
ছবি:- হাট শুরু খালের সুন্দর রাস্তা ধরে। ভাই ভোন সবার আগে। |
ছবি:- মামুন ভাই নিচের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাটছে। |
ছবি:- সৈকত দা হরিণের সিং পেয়ে কি যে খুশি। |
ছবি:- খাল পাড়ের সময় আমি আর ইয়ান। |
আবশেষে আমরা যখন বাজারে আসলাম তখন প্রায়
দুপুর , কিন্তু আমরা স্রেফ চা নাস্তা আর শুকনো খাবার খেলাম আর কিনলাম। প্রচুর
পানিও কিনলাম “আলাদিন” এ
দোকান থেকে। আলাদিন কে পেলামনা খুজে। মন খারাপ হলোনা কারণ যখন শুনলাম সে স্কুলে
গেছে। গতবার সে বলছিল সে স্কুলে পড়ে না , এবার এসে শুনলাম সে ভর্তি হয়েছে। খুব ভাল
লাগলো। বাজারের পরিচিতদের সাথে দেখা করলাম আর যার যার ছবি তাদের দিয়ে দিলাম। তংচং
দার সাথেও দেখা হলোনা। উনি আলিকদম গিয়েছেন। তাই তার মেয়ের ছবি তার ছেলের হাতে
ধরিয়ে দিয়ে আমরা রওনা দিলাম মেনকেট মেন’ক পাড়ার দিকে। সবাই প্রশ্ন করল “সজল
সামনের রাস্তাটা সহজ তো ? উঠানামা বেশি নেইতো? “ আমি বললাম “পিস আব কেক” ভরসা ওয়ালা হাসি দিলাম। কিন্তু মনে মনে
বলছিলাম “ তোমাদের
তো কোন “আইডিয়াই”
নেই কোই যাচ্ছি”
আমরা প্রায় ১৫ মিনিট হাটার পর , পথে প্রায়
দেড় ঘন্টা একটা বড় ঝিড়িতে লাফালাফি করলাম। গোসোল করলাম। যারা সাঁতার জানে তারা
ব্যাক স্ট্রোক , ডুব সাতার আর করসাজি প্রদর্শণ করতে লাগলো। আর হলের বাথরুমের মত
তবাই ঝোপে লাইন দিল টয়লেট করার জন্য। মামুন ভাইতো পাক্কা ১ ঘন্টা ঝোপের আড়ালে
কাটিয়ে দিয়ে আসলো।
এরপর আমরা সবচেয়ে সুন্দর ঝিরি পথ দিয়ে হাটা
শুরু করলাম , সবার মুখে ওয়াও আর ওয়াও। পুরো ঝিরিতে খালি পাথর আর পাথর।
ছবি:- আধো আলো। |
পথে মেনকেট মেন’ক
পাড়ায় বেশ কিছু ছেলের সাথ কথা হলো ভাংঙ্গা ভাংগা বাংলায় । জানতে পারলাম “সাংগা”
দাদার জুম ঘর এখন পরিত্যাক্ত আর উনি নিচে থাকেন। তাই জুম ঘরে যেয়ে লাভ নেই আর তার
ছেলেকেই পেলাম পথে। তাকে সাংগা দাদার ছবি আর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে রওনা হয়ে গেলাম
, যেহেতু সাংগা দাদার জুম আর নেই তাই লক্ষ্য পালটে গেল। এখন আমরা যাবো মিনাঙ্গ
পাড়ায়। সুন্দর পাথুরে ঝিরিদিয়ে কখনো আলো আধারের গহিন পাহাড় বা ঝিরি আথবা জংঙ্গল
দিয়ে গিয়ে আমরা শামুক ঝিরিতে গিয়ে পড়লাম।
ছবি:- শামুক ঝিরির প্রাকৃতিক দরজা। |
ছবি:- জল পাথরের আড্ডায় সৈকত দাদা। |
এরপর শূরু হলো আমাদের আসল কষ্ট। খাড়া পাহাড়
এখন খালি মিনাঙ্গ পাড়া পর্যন্ত। উঠছি আর উঠছি। পথে ইচ্ছে মত রেস্ট নিসি। ইচ্ছে মত
লেটাইছি আর শুকনো খাবার খেয়েছি। এবারো পাড়ায় পৌছাবার অনেক আগেই খাবার পানি শেষ।
রেশনিং কর চলতে হলো ।
ছবি:- বিশাল তুলা গাছ। |
ছবি:- পাহাড়ী ট্রেইলে রেস্ট। |
কি ভাই পাড়া আসেনা আসেনা করে একসময় আমরা
কুকুরের ডাক শুনত পেলাম।আহা কুকুর মানে পাড়া। পাড়ায় ততক্ষনে জুমন , হাসান আর এমিলি
পৌছে গেছে। আমরা ও যাই সোজা কারবারির ঘরে হাজির হলাম শুকর দের পাশ কাটিয়ে। যে
পারার কয়েক মাস আগেও মাত্র ৩-৪ টা ঘর ছিল সেখানে এখন ১০টার উপরে ঘর। তবে পাড়াটা
খুবই সুন্দর আর পরিস্কার। কারবারী মিনাঙ্গ ছিলনা। তাই দিদি থেকে অনুমতি নিয়ে আমরা
রান্না চড়িয়ে দিলাম। আমি আর রুপা দি বাবুর্চি। এদিকে মামুন , হাসান , জুমন ও এমিলি
চলে গেল রুংরাং সামিট করতে।
ছবি:- সুর্যাস্থ । চুলোয় রান্না চাপিয়ে আমরা সুর্যান্থ দেখি। |
সবাই চলে এলে অমরা জাম্পেশ একটা বিকালের
নাস্তা করলাম সুপ-নুডুলর্স আর বিস্কিট দিয়ে। এরপর সবাই মিলে আড্ডা দিলাম ঘরের
ভেতরে। হাসি –
মজা। ইয়ান অনেক গুলো গিফ্ট নিয়ে আসছিল। সেগুলো পাড়ার দিদি , দাদা আর বাচ্চাদের
দেওয়া হলো।এরপর আমরা আবার খিচুড়ি রান্না করে খেয়ে দেয়ে ঘুমাতে গেলাম রাতের প্রায়
১০টা বাজে,যেখানে পাড়ার লোকজন ৮টার ভেতরেই ঘুমিয়ে যায়।
১৪/০৪/২০১৪
-------------------------------
সকালে ঘুম থেকে উঠে একটা ঠান্ডা বাতাসের
ঝাপ্টা লাগলো ঘরের ভেতরে। আমি জ্যাকেট গায়ে চড়িয়ে বের হলাম। আমাদের টিমের কয়েকজন
বাইরে তাবু খাটিয়ে ঘুমিয়েছিল,তাদের ক্যাম্প আগে দেখলাম। শুয়োর ছাড়া অবস্থায় থাকে
তাই তাবু ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলা হয়েছিল একটা বাগানের ভেতরে।
ছবি:- তাবু – ১। |
ছবি:- তাবু – ২। |
আমরা নাস্তা করে যখন বের হলাম তখন আমাদের
সামনের পথের জন্য পানি সংগ্রহ সবচেয়ে বড় কাজ। আর পাড়ায় এখন পানি সংকট। ঝিরিতে পানি
নেই। তাই তারা খুব সুন্দর একটা উপায়ে কুপের মত স্থানে পানি সংগ্রহ করছে পাড়ার
প্রয়োজনে। একদম আল্প , আমরা অনুমতি নিয়ে পানি সংগ্রহ করলাম আর ভাবতে লাগলাম সামনের
গরমে তো আরো পানি সংকটে পড়বে। আসলেই এ
পাহাড়ী লোক গুলোর জীবন অনেক কস্টের।
দাদারা উঠানে আগুনে হাত পোহাচ্ছিল।আমরা সকল
ময়লা দাদাদের হাত পোহাবার আগুনে পুড়িয়ে হাটা শুরু করলাম,একটা গ্রুপ ছবি তুলেই।
ছবি:- গ্রুপ ফটো। ইয়ান আর জুমন মিসিং। মনেহয় ঝোপে ঝাপে গিয়েছিল। |
হাটতে হাটতে ইয়ানের সাথে সবাই মজা করতে
লাগলো। বেচারা সকালের কর্ম সারতে গিয়ে শুকরের তাড়া খেয়ে একেবারে কাপড়ে –
চোপড়ে করে ফেলল।
পথেই রুংরাং পড়লো। যারা গত সন্ধ্যায় সামিট
করছে করছে , আমার কেন জানি সামিট করতে আগ্রহ লাগলোনা। রুপা দি কতক্ষন লাফালো সামিট
করার জন্য , আমি বললাম আমার অত তেল নেই। সো সবাই রুংরাং এর নিচের স্লোপে বসে রেস্ট নিয়ে কানচন পাড়ার পথে হাটা শুরু করলাম।
কানচন পাড়ায় এসেই খুব খারাপ খবর শুনলাম। “কানচন দাদা” মারা গেছেন। তার ফটো দেয়ার মতও কাউকে
পেলামনা। তাই আমরা নতুন কান্চন পাড়ার পথে রওনা দিলাম।
ছবি:- নতুন কান্চন পাড়া। |
এখান থেকে আমরা কেউই পথ চিনিনা। তাই ডন
দাদাকে গাইড হিসাবে নিলাম আমরা। আর ডন দাদার কাছে কানচন দাদা আর উনার ছেলেদের ছবি
দিয়ে দিলাম। ডন দাদা আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো। পথে এটা ওটা –
এটা সেটা দেখাতে লাগলো। আমাদের একটা গন কবর দেখালো , যেখানে শান্তি বাহিনী ৩৫ জন
মুরংকে গুলি করে মেরে রেখে গিয়েছিল। ট্রেইলটা খুব সুন্দর আর গত দুই দিনের তুলনায় সহজই
ছিল। পাহাড়ের পাশ ঘেসে। আমি ক্যামেরা না থাকায় মোবাইলে ফটো তুলছি দেখে ডন দাদা তার
সিম্ফোনি মোবাইল বের করে টার্চ স্ক্রিন টিপতে লাগলো আর বলল “তুমি
এখনো এ মোবাইল ব্যাবহার কর ? আমার টা আঙ্গুল লাগালেই কাজ করে”
আমি মুচকি হাসলাম আর বললাম “তোমাদের
এখানেতো নেটওয়ার্কই নেই মোবাইল দিয়ে কি কর ? সে বলল “
আজ কাল তার খেতের আর বাঁশের ব্যাবসা ভালো। পাহাড়ের উপরে উঠলে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়,তখন
কাজ দেয়।
ছবি:- সুন্দর ট্রেইল |
ছবি:- ট্রেইল। |
ডন দাদা বেশিদুর গেলনা। একটা ঝিরিতে নামিয়ে
বিদায় নিয়ে চলে গেল। আমরা আবার একা হয়ে গেলাম বিশাল পাহাড় আর জংগলে।
ছবি:- পাহাড় আর ব্যাকপ্যাক। |
ছবি:- যেন নেপাল। পাহাড়ের পাশ ঘেষে রাস্তা।
|
আমরা যখন পাড়ায় পৌছলাম তখন দুপুর গড়িয়ে
গেছে। রান্না করে খেয়ে আমরা কারবারী দাদকে ধন্যবাদ দিয়ে আবার পথে নামলাম।
ছবি:- এক দিদি বানরের বাচ্চা হাতে। |
ছবি:- পাড়া কে বিদায়। |
ছবি:- এমিলি ঝিরি পার করছে। |
ছবি:- আরেকটা জান্নাতের দরজা যেন। |
এরপর হাটা আর হাটা। একসময় আমরা ঝিরি পথ ধরে
শহুরে রাস্তার অনেক কাছে চলে আসলাম। আবার শহর , যানজট আর দু:সহ জীবন। কেনযে
বান্দরবানে একেবারে থেকে যায়না।
আমরা যখন রাস্তায় উঠলাম মুরং পাড়াকে পাশে
কাটিয়ে তখন সন্ধ্যা হতে আর দেরি নাই। একটা দোকানে ডিম আর কেক খেয়ে নিলাম। ডিম
ছিলার সহজ উপায় ছিল জুমনের কপালে ভাঙ্গা। ডিম খেয়ে আমরা মাল বোঝাইয়ের সেই একটা
ট্রাক যাত্রা শুরু করলাম। সাথে ঝুম বৃষ্টি আর বাতাস। বান্দরবানো আমাদের সঠিক ভাবে
বিদায় দিল।
[নোট:- কোথাও গেলে জায়গাটা নষ্ট না করেই
ঘুরে আসুন। আর তা যদি সম্ভভ না হয় তবে যাওয়ার-ই দরকার নেই। কিছু ফেলে আসবেননা।
একটা প্লাস্টিকের ছোট টুকরাও।কিছু নিয়েও আসবেননা শুধু কিছু ছবি আর প্রচুর মেমোরি
ছাড়া।]
3/ সেন্টমার্টিন দ্বীপে তাবুবাস। 4/ বান্দরবানে হারিয়ে যাওয়ার গল্প।
Valo laglo,,,mne holo ameo ghure ashlm apnader shathe.
উত্তরমুছুন